খাদ্য কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে আমরা তোমাদের মাঝে স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে আলোচনা করব যেটি হলো খাদ্য। আমাদের শরীরের সুস্থ রাখার জন্য এবং স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। সুতরাং আমাদের দৈনিক কিছু প্রয়োজনীয় সুস্থ খাদ্য দরকার। তাই আমরা আজকে জানবো খাদ্য কাকে বলে এবং খাদ্য কত প্রকার ও কি কি, নিচে খাদ্য কাকে বলে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
খাদ্য কাকে বলে
খাদ্য বলতে আমরা এমন সকল আহার্য পদার্থ বুঝি যা আমাদের দেহের বৃদ্ধি, পুষ্টি, শক্তি উৎপাদন, ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ করে। তাকে খাদ্য বলে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, যেসব খাবার খেলে আমাদের দেহ সুস্থ থাকে এবং ভালোভাবে কাজ করে, সেগুলোই খাদ্য।
খাদ্যের প্রকারভেদ
মানুষের দেহে খাদ্যের ভূমিকা অনুসারে, ২ টি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায় যথাঃ
- দেহ-পরিপোষক খাদ্য
- দেহ-সংরক্ষক খাদ্য
দেহ-পরিপোষক খাদ্য কাকে বলে
- শরীরের কোষ গঠন, বৃদ্ধি ও মেরামতে সহায়তা করে।
- শরীরে শক্তি সরবরাহ করে।
- এই শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে–শর্করা (কার্বোহাইড্রেট),আমিষ (প্রোটিন),স্নেহপদার্থ (চর্বি)
দেহ-সংরক্ষক খাদ্য
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- শরীরের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
- এই শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে–ভিটামিন,খনিজ পদার্থ (মিনারেল)
খাদ্যের উপাদান সমূহ
খাদ্যে মোট ৬টি উপাদান থাকে যথাঃ শর্করা ,আমিষ বা প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং জল
শর্করা (কার্বোহাইড্রেট)
শর্করা (কার্বোহাইড্রেট) হল জৈব যৌগ যা কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন নিয়ে তৈরি। এগুলো আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস এবং শরীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিছু প্রকারভেদ শর্করা এর
- মনোস্যাকারাইড: সবচেয়ে ছোট শর্করা, যেমন গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং গ্যালাক্টোজ। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ফল, শাকসবজি এবং মধুতে পাওয়া যায়।
- ডাইস্যাকারাইড: দুটি মনোস্যাকারাইড যুক্ত, যেমন সুক্রোজ (টেবিল চিনি), ল্যাক্টোজ (দুধে পাওয়া যায়) এবং ম্যাল্টোজ (শস্যে পাওয়া যায়)।
- পলিস্যাকারাইড: অনেক মনোস্যাকারাইড একসাথে যুক্ত, যেমন স্টার্চ (আলু, ভাত এবং শস্যে পাওয়া যায়), গ্লাইকোজেন (যকৃত এবং পেশীতে শক্তি সঞ্চয় করে) এবং সেলুলোজ (উদ্ভিদের কোষের দেয়াল তৈরি করে)।
শর্করার কাজ
- শরীরের প্রধান শক্তির উৎস।
- মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- পেশী এবং অঙ্গগুলির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- হজমে সাহায্য করে।
সুস্থ থাকার জন্য, বিভিন্ন উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ শর্করা প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং মিষ্টি খাবার থেকে পেলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আমিষ বা প্রোটিন
আণবিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমিষ বা প্রোটিন হল পেপটাইড বন্ধন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার শৃঙ্খল। আমাদের শরীরে, আমিষ কোষ এবং টিস্যুর গঠন, মেরামত এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়। এটি এনজাইম, অ্যান্টিবডি, হরমোন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অণুরও গঠন করে।
আমিষের গুরুত্ব
- শরীরের কোষ গঠন ও বৃদ্ধি: আমিষ আমাদের শরীরের কোষ তৈরি ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে।
- পেশীর গঠন ও মেরামত: পেশী তৈরি ও মেরামতের জন্য আমিষ অপরিহার্য।
- হাড় ও দাঁত গঠন: হাড় ও দাঁতের গঠন ও শক্তি বজায় রাখার জন্য আমিষ প্রয়োজন।
- চুল ও নখের স্বাস্থ্য: ত্বক, চুল ও নখের স্বাস্থ্যের জন্য আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: আমিষ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- হরমোন ও এনজাইম তৈরি: আমিষ হরমোন ও এনজাইম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে।
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: আমিষ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
প্রতিদিন কতটা আমিষ/প্রোটিন প্রয়োজন?
প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ থেকে ১ গ্রাম আমিষ/প্রোটিন প্রয়োজন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের জন্য জন্য প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন। তাই প্রতিদিন খাবারের সাথে আমাদের আমিষ জাতীয় খাদ্যগরুর মাংস, খাসির মাংস পেস্তা বাদাম, চীনা বাদাম, , ভাত রাখা খুবই প্রয়োজন।
স্নেহপদার্থ
স্নেহপদার্থ, যা চর্বি নামেও পরিচিত, হলো জৈব যৌগের একটি শ্রেণী যারা সাধারণত জৈব দ্রাবকে দ্রবণীয় কিন্তু জলে অদ্রবণীয়। রাসায়নিক গঠন বিবেচনা করলে, স্নেহপদার্থ হল গ্লিসারল ও ফ্যাটি অ্যাসিডসমূহের ট্রাই-এস্টার। প্রাকৃতিক খাদ্যের মধ্যে কম বেশি স্নেহজাতীয় পদার্থ পাওয়া যায় যেমনঃ নারীকেল, বাদাম, সরিষা, তুলার বীজ, মাখন,ঘি ইত্যাদি।
স্নেহজাতীয় পদার্থের কিছু ভূমিকা রয়েছে যেমন
- শক্তির উৎস: স্নেহপদার্থ আমাদের শরীরের জন্য শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রতি গ্রাম স্নেহপদার্থ ৯ ক্যালোরি শক্তি সরবরাহ করে।
- কোষের ঝিল্লী তৈরি: স্নেহপদার্থ আমাদের কোষের ঝিল্লী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ভিটামিন A, D, E এবং K শোষণে সাহায্য করে: এই ভিটামিনগুলো চর্বি-দ্রবণীয়, তাই স্নেহপদার্থ ছাড়া আমাদের শরীর সেগুলো শোষণ করতে পারে না।
- অঙ্গগুলিকে রক্ষা করে: স্নেহপদার্থ আমাদের অঙ্গগুলিকে কুশন করে এবং ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে।
- হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে: কিছু স্নেহপদার্থ হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।
স্নেহপদার্থ আমাদের শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। সুস্থ থাকার জন্য, আপনার খাদ্যে বিভিন্ন ধরণের স্নেহপদার্থ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ভিটামিন
ভিটামিন হলো জৈব যৌগ যা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এগুলো খাবার থেকে অল্প পরিমাণে পাওয়া যায় এবং পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে তাকে ভিটামিন বলে। যেমনঃ দুধ, ডিম, মাছ, মাংস,তেল, বাদাম, ঢেঁকিছাটা চাল, লাল আটা, ছোলা, মুগ, পালংশাক, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লেবু, আম, আমলকি, আপেল ইত্যাদি।
ভিটামিনের প্রকারভেদঃ
- চর্বি-দ্রবণীয় ভিটামিন: এগুলো চর্বির সাথে মিশে রক্তে দ্রবীভূত হয়। এই ভিটামিনগুলো হলো ভিটামিন A, D, E এবং K।
- জল-দ্রবণীয় ভিটামিন: এগুলো জলের সাথে মিশে রক্তে দ্রবীভূত হয়। এই ভিটামিনগুলো হলো ভিটামিন B কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন C।
- ভিটামিনের কাজ:
- শরীরের কোষের বৃদ্ধি ও মেরামত: ভিটামিন কোষের বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: ভিটামিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- হাড় ও দাঁত গঠন: ভিটামিন হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়।
- স্নায়ু ও পেশীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ: ভিটামিন স্নায়ু ও পেশীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা: ভিটামিন শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- চোখের দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখা: ভিটামিন চোখের দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখা: ভিটামিন ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে কতটা ভিটামিন প্রয়োজন তা নির্ভর করে তার বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক অবস্থা এবং খনিজ লবণ বলে কার্যকলাপের উপর।
খনিজ লবণ
খনিজ লবণ হলো কিছু অজৈব পদার্থ যা আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। এগুলো খাবার থেকে আসে এবং জীব দেহের স্বাভাবিক পুষ্টির অভাব পূরণ,জীব দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য,রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও তৈরি করে তাকে খনিজ লবণ বলে।
কিছু খনিজ লবণের প্রকারভেদ
ম্যাক্রো মিনারেল: আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় খনিজলবণের মধ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
ট্রেস মিনারেল: আমাদের শরীরে অল্প পরিমাণে প্রয়োজনীয় খনিজ লবণের মধ্যে লৌহ, দস্তা, তামা, আয়োডিন, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
খনিজলবণের কাজ:
হাড় ও দাঁত গঠন ও বৃদ্ধি: ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য অপরিহার্য।
স্নায়ু ও পেশীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ: ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়াম স্নায়ু ও পেশীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
রক্ত তৈরি: লৌহ রক্ত তৈরির জন্য অপরিহার্য।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: জিঙ্ক এবং আয়োডিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা: সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
হরমোন ও এনজাইম তৈরি: কিছু খনিজ লবণ হরমোন ও এনজাইম তৈরিতে সাহায্য করে।
জল বা পানি
পানি কেবল খাদ্যের একটি উপাদান নয়, বরং মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দেহের গঠন ও কার্যকারিতা জল ছাড়া সম্ভব নয়।
দৈহিক ওজনের ৬০-৭০% অংশ জল দ্বারা গঠিত। আমাদের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত, হাড় এবং অন্যান্য অঙ্গ গঠনের জন্য পানি অপরিহার্য।
পরিমাণমত পানি পানের গুরুত্ব:
- দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ক্লান্তি ও ক্ষুধা দূর করে।
- মাথাব্যথা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন গড়ে 2.5-3 লিটার পানি পান করা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, খাদ্য হলো আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ যা আমাদের বেঁচে থাকতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুতরাং আমাদের খাদ্যের গুনাগুন সম্পর্কে জেনে প্রতিনিয়ত পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত তাই আমরা সকলেই পরিণত খাদ্য গ্রহণ করার চেষ্টা করব অতএব আমরা আশা করছি আপনাদের উপরের তথ্যগুলো ভবিষ্যতে যে কোন কাজে সাহায্য করবে তাই খাদ্য সম্পর্কে আরো কোন তথ্য জানতে চাইলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে আমাদেরকে জানাতে পারেন ‘ধন্যবাদ’